করোনার মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি
সরকারি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয়ও বেশি হয়েছে তিন কোটি মার্কিন ডলার।
রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর গবেষক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার সুফল মিলবে পুরো অর্থনীতিতে। গুরুত্বপূর্ণএই দুটি খাত শক্তিশালী হলে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সাহায্য করবে। রেমিট্যান্স দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে সহায়তা করবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরি করবে। আর রফতানি আয় বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়া কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রভাব পড়ার কথা ছিল রফতানি বাড়ার কারণে সেটা হবে না।’
ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির মধ্যে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের (২০২০-২০২১) প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের (২০১৯ সালের স্বাভাবিক সময়ে) একই সময়ের তুলনায় রফতানি আয় বেশি হয়েছে অন্তত তিন কোটি মার্কিন ডলার। শুধু তাই নয়, করোনার বাস্তবতা সামনে রেখে রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তার চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে।
ইপিবি বলছে, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৪৪ কেটি ৯০ লাখ ডলার। অথচ এই খাতে আয় হয়েছে ৩৯১ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রথম মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একই সঙ্গে অর্জিত রফতানি আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ৩৮৮ কোটি মার্কিন ডলার।
জুলাই মাসে রফতানি আয় বাড়ার মধ্য দিয়ে নেতিবাচক ধারা থেকে রেড়িয়ে এলো এই খাত। অর্থাৎ সাত মাস পর বাংলাদেশ রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে এসেছে।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল রফতানি আয়ে। এর পর ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমছিল।
গত মার্চ থেকে করোনা মহামারির ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে শুরু করে। এপ্রিলে রফতানি কমে ৫২ কোটি ডলারে নেমে আসে। এপ্রিল মাসে আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে রফতানি আয় কমেছিল ৮৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অবশ্য মে মাসে রফতানি বেড়ে ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। তবে প্রবৃদ্ধি কমে ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ নেমে আসে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রফতানি আয় বেড়ে ২৭১ কোটি ৪৯ লাখ ডলারে উঠলেও প্রবৃদ্ধি কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, করোকানাকালে রফতানি আয়ের এই সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন গার্মেন্ট মালিক ও এই খাতের শ্রমিকরা। তারা একদিকে শ্রোতের বিপরীতে অর্থাৎ করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও কারখানা খোলা রেখে উৎপাদনে ছিলেন। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তারা শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘শ্রোতের বিপরীতে সাধারণ ছুটির মধ্যেও কারখানা খুলে দেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুফল এখন রফতানি খাত পাচ্ছে। রফতানি খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই খাতের সঙ্গে আরও অনেকগুলো খাত সম্পৃক্ত। রফতানি খাত শক্তিশালী হলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এ কারণে রফতানি খাতে যেসব সমস্যা এখনও বিদ্যামান রয়েছে, তা দূর করা সম্ভব হলে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়বে। একইভাবে রফতানির পরিমাণও বাড়বে।’
এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রফতানি আয় বেড়ে যাওয়ার খবর খুবই আশাব্যঞ্জক এবং ভালো খবর। তবে সংকট কেটে যাচ্ছে এর মানে তা নয় কিন্তু। জুলাই মাসে যে রফতানি আয় দেশে এসেছে তা মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের অর্ডারের। বাস্তবতা হলো আমাদের হাতে নতুন অর্ডার কম আসছে। ফলে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে রফতানির চিত্র খুব ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
ইপিবি’র তথ্য বলছে, জুলাইয়ে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৮৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। সেখানে আয় হয়েছে ৩২৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় বেশি হয়েছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের বড় অংশ (৮৫ শতাংশ) জোগায় তৈরি পোশাক। আর এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক সরাসরি যুক্ত রয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার এই সময়ে প্রতিদিনই প্রবাসীরা আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। আর গত জুন মাসের চেয়ে বেড়েছে ৪২ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে প্রবাসীরা ২৬০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। গত বছরের জুলাইতে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। এই হিসেবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে এক বিলিয়ন ডলারের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, একক মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। গত জুন মাসে প্রবাসীরা ১৮৩ কোটি মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। জুন মাসে এটি ছিল রেকর্ড। তবে সেই রেকর্ড ভেঙে জুলাইতে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহতভাবে বাড়ার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলারের সবোর্চ্চ রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা এযাবতকালের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ।
প্রসঙ্গত, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এক কোটিরও বেশি প্রবাসীর পাঠানো অর্থ। যা দেশের জিডিপিতে অবদান রাখে প্রায় ১২ শতাংশের মতো।
করোনায় কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকা
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।দেশের জিডিপি তে কৃষির অবদান ১৩.৪০% এবং দেশের জনশক্তির ৪০.৬% কৃষিকাজে নিয়োজিত (অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯)।করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে বিশ্ব-এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন বিশ্ব সংবাদ সংস্থা। আর এ কঠিন দুর্যোগেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে এই কৃষি খাত। মূলত বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে কৃষি ,তৈরি পোশাক ও প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্সের উপর। শেষের দুটি কোন চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নয় কিন্তু কৃষি চিরস্থায়ী। নানা রকম প্রতিকুলতা মোকাবিলা করেও তারা টিকে থাকে, জাতিকে ক্ষুধা মুক্ত ও অপুষ্টি থেকে রক্ষা করে।
করোনার কারনে শিল্প,কারখানা , পরিবহন,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকলেও বন্ধ থাকেনি কৃষি ও কৃষকের উৎপাদন কর্মকাণ্ড। সফলভাবে হাওড়ের বোরো ধান কাটতে পারা এবং এখন পর্যন্ত ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকের মনে কিছুটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।বাংলাদেশে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি আছে মাত্র ০.৮ হেক্টর, যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি।এ অবস্থা স্বত্তেও গত বছর প্রায় ৪ কোটি ৪৬ লাখ টন দানা জাতীয় খাদ্যশস্য আমরা উৎপাদন করেছি। ফলে আমাদের মোট জাতীয় আয় ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
কৃষি অধিদপ্তদের মতে করোনা কালীন সময়ে ৪৭.৫৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয় এবং আবাদের লক্ষমাত্রা ২, ৯৪,৩৬,০০০ মেট্রিক ট্রনের বিপরীতে আবাদ হযেছে প্রায় ৩ কোটি মেট্রিকটন।এ বছর সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান,১০ লক্ষ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল,১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহ করে গুদামজাত করেছে।সরকারের সহযোগিতা ও উতপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ ধান উত্পাদনে ইন্দোনেশিয়া কে ছাড়িয়ে ৩য় অবস্থানে।আলু,গম আগেই তোলা হয়েছে, আউশধান ও পাট বোনা হয়েছে। ভয় ছিল তরমুজ নিয়ে কিন্তু সরকারের হস্তক্ষেপে জরুরী পন্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু করায় সেটাতেও এসেছে সাফল্য। দেশের মানুষ এই ক্রান্তিকালেও মধুমাসের সকল ফল এর যোগান পাচ্ছে এই মেহনতি হাত সচল থাকায়।আস্পানের বিধ্বংসী আগ্রাসনে ১৫% আম নষ্ট হবার পরেও রাজশাহী ও দিনাজপুরে সর্বমোট ৬০ মেট্রিক টনের মতো আম ও লিচু উৎপাদন হয়েছে।করোনাকালীন সময়ে সরকারের বিভিন্ন শর্ত আরোপে গবাদি পশু উতপাদন অবিক্রিত থাকবে ৬০% তার পরেও এ খাত টিকিয়ে রেখেছে দেশের অর্থনীতিকে।
করোনা ভাইরাস এর প্রভাবে কল কারখানা বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়া প্রায় ২ কোটি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছেন।কেউ কেউ গ্রামে ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তার একখন্ড অনাবাদী জমিতে ফসল ফলাতে।আবার এত অধিক মানুষের ভারে গ্রামের আবাসন, কর্মসংস্থান ও খাদ্য যোগানে কিছুটা চাপেরও সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে করোনার প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষককে টিকিয়ে রাখতে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ( মোট বরাদ্দের ৩.৬%) বরাদ্দ দেওয়ায় আশার আলো দেখা গিয়েছে। কৃষিখাতে গতি আনয়নে সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা সহ বিভুন্ন ভর্তুতি রেখেছে বাজেটে।বাজেটে আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫০%,কৃষি পণ্য রপ্তানিতে ২০% এবং কৃষিখাতে বিদ্যুত বাবহারে কর রেয়াত ২০% ঘোষনা করা হয়েছে।বাজেট অধিবেশনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের শিকড়কে সন্ধান করতে বলেছেন,আর আমাদের শিক্ড় হলো আমাদের কৃষি, যা আমাদের অর্থনীতির বৃহত্ চালিকাশক্তি।ইতোমধ্যেই সরকার কৃষি বীমা করার পরিকল্পনা করেছে।খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে মধ্যমেয়াদী (২০২০-২০২৩) পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। দেশের ফসল উৎপাদন সহ কৃষক, কৃষি শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের জীবন জীবিকা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ। কেননা গ্রামের উন্নয়ন ও গ্রামীণ উন্নয়ন বলতে গেলে শুরুতেই আসে কৃষি ও কৃষি ভিত্তিক শিল্প, বানিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। আমাদের নদীচর বিশেষত পদ্মা, মেঘনা যমুনা নদীর তিন- চার লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য চরাঞ্চলে অর্থকরী ফসলের আবাদ শুরু করে আমরা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারি।
কৃষিখাতে করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রভাব খুব সীমিত। এই প্যাকেজ কৃষিতে করোনার প্রভাব রোধসহ কৃষিকে বেগবান করবে বলে আমরা আশা করা যায়।
এতদ্সত্ত্বেও করোনার প্রাদুর্ভাবে এদেশে মৌলিক অর্থনীতি তথা কৃষিখাতের ওপর প্রভাব যাতে না পড়ে সে ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে-
১) সরকার কৃষিক্ষেত্রে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সে প্যাকেজের উদ্দেশ্যমতে উপযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক যথোপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা।
২) কৃষিখাতের প্রণোদনা পাঁচ হাজার কোটি (৪% সুদে) থেকে আরও বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। কৃষিখাতকে শক্তিশালী করাই হওয়া উচিত করোনা অর্থনীতির মূল কাজ।
৩) কৃষিতে চলতি মূলধনভিত্তিক খাত যেমন- হর্টিকালচার, মৎস্য, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্থসংস্থান জরুরিভিত্তিতে করা সম্ভব হলে কৃষিখাতে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে আশা করা যায়।
৪)এই মুহূর্তে শস্য ও ফসলখাতেও প্রণোদনা প্রয়োজন। শস্য ও ফসল উৎপাদন পূর্বের অবস্থা বজায় রাখা এবং উৎপাদনকে আরও বেগবান করা দরকার। কারণ এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না এবং চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে কিনা এসব বিষয় আরেকটু ভেবে দেখা দরকার।
৫) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এই লোন দিতে বাধ্য নয় বরং লোন আদায়ের দায়ভার ওই ব্যাংকের ওপর ন্যস্ত। তাহলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ ধরনের লোন প্রদানে কতটা আগ্রহী হবে! এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পরিপত্রে বাধ্যতামূলকভাবে লোন দিতে হবে উল্লেখ করলে ভালো হতো।
৭) আমাদের কৃষক ভাইয়েরা এই করোনাযুদ্ধের সৈনিক বলে আমি মনে করি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকভাবে কৃষক ভাইয়েরা করোনা মোকাবিলায় ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে শামিল থাকে সেক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষক নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে।
৮) প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, বালাইনাশক, সেচ ব্যবস্থাপনাসহ কৃষি যন্ত্রপাতির প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা না হয় সে দিকে কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
৯) কৃষকদের উৎপাদিত মৌসুমি ফসল ধান, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল, তেলবীজ, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, গুড় ও পাটসহ অন্যান্য ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১০) রাজস্ব খাতের প্রণোদনা ও বাস্তবায়ণাধীন কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
১১) কৃষিপণ্যের পরিবহন, গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ নির্বিঘ্ন হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
১২) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নির্দেশনা- চাষযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল উৎপাদন করতে হবে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কৃষিবিভাগকে অত্যন্ত আন্তরিক হতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়,কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির উপর নির্ভর করেই অর্থনীতিকে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব। আর,উপরোক্ত বিষয়াদি পালন অব্যাহত থাকলে কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে,ঘুরে দাঁড়াবে বঙ্গবন্ধুর কৃষি অর্থনীতির বাংলাদেশ।
করোনা-উত্তর এক সবুজ পৃথিবীর অপেক্ষায়
অন্তত সচেতনতার দিকটাই নজর দিলে পরিস্থিতি এমন নাজুক হতো না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে আমাদের দুর্বলতা থেকেও আমরা শিখছি। তাই এই মুহূর্তে কৃষি, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনাসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা সম্ভব হবে। নিঃসন্দেহে কৃষি এবারও ভালো করেছে। তাই খাদ্য সরবরাহ নিয়ে সরকারকে তত ভাবতে হচ্ছে না। গ্রামে ছোটখাটো অনেক কৃষি ও অকৃষি উদ্যোক্তার হাতে ঠিকমতো অর্থ দিতে পারলে তারা অভ্যন্তরীণ চাহিদার ধারাটি বজায় রাখতে সক্ষম হবেন। আয়-রোজগার নেই বলে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন।
সেখানকার অর্থনীতিও বেশ খানিকটা সচল। সে কারণেই সুনির্দিষ্ট টার্গেট ধরে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য তৈরি প্রণোদনা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরেকটু তত্পর হতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে কারা টাকা পেলেন, কতটা ব্যবহার করলেন, আরো চাহিদা কত—এমন ধারার মনিটরিং খুবই সহজ। আশা করছি, দ্রুতই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে ফেলবে এবং আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি গ্রামীণ অর্থনীতিকে কাঙ্ক্ষিত সহায়তা দিতে পারবে। তবে বড় উদ্যোক্তা তথা শিল্প ইউনিটের (বিশেষ করে যারা খেলাপি নন) পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে অর্থ উত্তোলনের গতি খুব একটা জোরদার হবে বলে হয় না। বাজারে চাহিদা বাড়লেই তাদের সক্রিয় হতে দেখা যাবে। তবে যারা নিয়মিত ইচ্ছাকৃত খেলাপি তারা হয়তো এই অর্থ পেতে খুবই তত্পর হবেন। কেননা তারা ঋণ নিতে যতটা তোড়জোড় করেন তা ফেরত দেওয়ার সময় ঠিক ততটাই নির্লিপ্ত থাকেন। অথচ ভালো উদ্যোক্তাদের এই সময়টায় আর্থিক প্রণোদনা দেওয়াটা খুবই জরুরি।
ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ দারুণ হারে কমে গেছে। ব্যক্তিখাতের ঋণের হারই তার প্রমাণ। কর্মসংস্থান বাড়াতে চাইলে এদের পাশে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংকগুলোকে আশ্বস্ত করার জন্য দ্রুত ক্রেডিট গ্রান্টি স্কিম চালু করা দরকার। শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বেই ব্যাপক হারে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ (গড়ে) এমন প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। কোনো কোনো দেশ জিডিপির ২০-৩০ শতাংশ প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন সরকার, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী এত অর্থ বিতরণের এই বিশাল সুযোগকে চাইলে টেকসই উন্নয়নের এক মাইলস্টোনে পরিণত করতে পারেন। এই মহামারির মধ্যেও তারা এমনভাবে এই প্রণোদনাকে সাজাতে পারেন, যাতে করে জলবায়ুসহিষ্ণু টেকসই-অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়। সবুজ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। পরিবেশ সংরক্ষরণে আরো এক পা হাঁটা যায়। নেতৃত্বের এই সবুজ মনোযোগেই গড়ে উঠতে পারে এক নয়া সবুজ পৃথিবী। এটা শুধু নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন নয়। এটা ভালো অর্থনীতিরও প্রশ্ন।
করোনা সংকট এমন এক সময়ে এলো, যখন আমরা জলবায়ুসহিষ্ণু উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণে এক অভাবনীয় বিশ্ব-ঐকমত্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অন্তত ৭৫ ট্রিলিয়ন টেকসই বিনিয়োগ করে প্যারিস চুক্তিকে কার্যকরী করার জন্য সরকার, ব্যক্তিখাত ও বেসরকারি খাত এক যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাত্ করে এই করোনা ভাইরাসের আক্রমণের কারণে এই পরিমাণ অর্থ সবুজায়নের স্বার্থে সমাবেশ করা সত্যি কঠিন হবে। বিশেষ করে বিদেশি ঋণে জর্জরিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে দ্রুত জীবন ও জীবিকা পুনরুদ্ধারের সময় এই সবুজ অর্থায়ন প্রাপ্তি অনেকটাই অনিশ্চিত হওয়ার পথে। তা সত্ত্বেও, আমাদের মতো দেশগুলো যেন টেকসই উত্পাদন ও ভোগের দিকে দৃষ্টি বজায় রাখে, সে আশাই করছি। বিশেষ করে, কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে সবুজ জ্বালানি উত্পাদন ও ব্যবহারে আমাদের সবাইকেই উদেযাগী হওয়ার এটিই শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে অনেক নীতিনির্ধারকই দ্বিধান্বিত থাকতেই পারেন। তবুও আমাদের সবুজ পথে হাঁটতেই হবে। তাই সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন বিনিয়োগে আমরা উত্সাহ দেখাতে পারি না।
এনজিও ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা হোম সোলার সিস্টেম, সৌর সেচ প্রকল্প ও রুফটপ সোলার সলিউশন কর্মসূচিতে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করছে। দূরাঞ্চলে সোলার মিনিগ্রিড গড়ে তুলেছে। সবুজ বিদ্যুত্ উত্পাদন ও বিতরণে সরকারি ও বেসরকারি খাত হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রিন ট্রান্সফরমেশন তহবিল থেকে অনেক কারখানাকেই সবুজ উত্পাদন ইউনিটে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এছাড়া ছোটখাটো উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে সবুজ ইট, ইটিপি, জৈব সারসহ নানা উদ্যোগে অর্থায়নের সুযোগ। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা সবুজ উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করতে পারি :
এক. সবুজ পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে যেসব উদ্যোগ সবুজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, জ্বালানিসাশ্রয়ী হয়ে কার্বন কমানোর অর্থনীতি গড়তে সাহায্য করবে—তাদের প্রণোদনার অর্থ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া হোক।
দুই. যারা করোনা-উত্তর বিনিয়োগে জলবায়ুসহিষ্ণু প্রযুক্তি ব্যবহারে উত্সাহী হবে এবং কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করবে তাদেরই প্রণোদনা প্রদানের সময় বাড়তি সমর্থন দেওয়া হোক।
তিন. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে সবুজ বিদ্যুত্ উত্পাদনের সৃজনশীল উদ্যোগকে বেশি বেশি উত্সাহ দেওয়া হোক।
চার. ‘নেট মিটারিং’-এর মাধ্যমে এমন রাজস্ব ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে যে মানুষ স্ব-উদ্যোগে সবুজ বিদ্যুত্ তৈরি করে। ন্যাশনাল গ্রিডে আমি বিদ্যুত্ দিলে তার ইউনিট দর আমি যে দামে কিনি তার চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি হতে পারে।
পাঁচ. সরকার নিজেই সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদনের বড় প্ল্যান্ট গড়ে তোলার যে উদ্যোগ সম্প্রতি নিয়েছে সেই ধারাকে আরো বেগবান করতে হবে।
ছয়. ইডকলের ‘রুফটপ সোলার সলিশন’ কর্মসূচিতে আরো বেশি অর্থ দিতে হবে।
সাত. কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ৭৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যার উদ্দেশ্য হবে জলবায়ুসহিষ্ণু বিদ্যুত্সাশ্রয়ী এবং সবুজ বিদ্যুত্ উত্পাদনকে উত্সাহ দেওয়া। আমরাও তেমন একটি বিশেষ সবুজ তহবিল গড়তে পারি।
আট. এই মহামারিকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে আমরা আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থানসহ সকল কর্মসূচিকে টেকসই করার কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করার অঙ্গীকার করতে পারি। ভবিষ্যতে যাতে এমন দুর্যোগ দেশবাসীকে কাবু না করতে পারে সেজন্য আমাদের জনস্বাস্থ্যসহ পুরো উন্নয়নের ধারাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করার ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে হবে।
নয়. জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। চলমান প্রণোদনা কর্মসূচিকে আমাদের এই সাফল্যকে আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য ব্যবহার করতে পারি।
দশ. উপকূলের ঘরবাড়ি এমন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারি, যাতে এসব মিনি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তাছাড়া উপকূলে সৌর ‘ডি-সেলাইনেজন প্ল্যান্ট’, জনস্বাস্থ্য কাঠামোর উন্নয়ন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, বন ও পাহাড় সংরক্ষণমূলক কর্মসূচি গ্রহণেও এই প্রণোদনার অংশ বিশেষ ব্যবহার করতে পারি।
এগারো. এই মহামারি থেকেই আমরা শিখছি কী করে ঘরে বসে অফিস করা যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি কম ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়। এও শিখছি যে কী করে ই-কমার্স ব্যবহার করে কৃষি পণ্য বিক্রয় করা যায়। কৃষি সরবরাহ চেইনকে সংক্ষিপ্ত করা যায়। নতুন নতুন ‘স্টার্টআপ’ চালু করা যায়।
সবশেষে বলতে পারি, সাময়িকভাবে ‘গ্রিন হাউজ গ্যাস’ উত্পাদন ২৫ শতাংশ কমে গেলেও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হলে যেন আমরা এই সংকটকালের সব কথা ভুলে না যাই। আমাদের জীবন ও জীবিকাকে আরো সবুজ করার যে শিক্ষা প্রকৃতি আমাদের এবারে দিল, তা যেন ভুলে না যাই। আসলেই আমরা করোনা-উত্তর এক সবুজ পৃথিবীর অপেক্ষায় আছি।
ড. আতিউর রহমান
করোনা আক্রান্ত অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাত
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং বিশেষত বিভিন্ন ওয়েবসাইট
অগণিত সত্য-মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা। নভেল করোনাভাইরাস ও তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটি স্পষ্ট।
মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, এ শত্রুরও মোকাবেলা করবে মানবজাতি আগে বা
পরে।
তবে সংকট-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দা যে আরেকটি যুদ্ধের হাতছানি, তা বিশ্লেষকরা নিঃসংকোচে মেনে নিচ্ছেন।
রাষ্ট্রীয় ও শিল্প পর্যায়ে তার মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর
জন্য করোনা-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি মোকাবেলা পূর্ববর্তী সব অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দাকে হার মানাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও আর্থিক সমস্যা এবং মন্দা সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক মন্দা আর্থিক খাতে বিশাল নেতিবাচক সমস্যার জন্ম দেয়, আবার
আর্থিক মন্দা অর্থনৈতিক মন্দায় রূপান্তরিত হয়।
পূর্ববর্তী সব মন্দা পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ আর্থিক ও অর্থনৈতিক মন্দা (২০০৭-২০) আমাদের এ ধারণাকে বারবার প্রমাণ
করেছে।
করোনা.পরবর্তী বিশ্ব অর্থনৈতিক ও
আর্থিক মন্দা এরই মধ্যে সর্বশেষ
বিশ্বমন্দার ভয়াবহতাকে অতিক্রম করেছে, এমন আভাস স্পষ্ট।
সামনের সময়গুলোয় এর ফলাফল তীব্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিচ্ছে ও
দেবে, যা আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। করোনা প্রতিরোধে কাজ করার
পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতকে রক্ষায় প্রস্তুতির সময় এখনই।
সর্বশেষ বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে ২০০৮-০৯ সালে প্রায় এক কোটি মানুষ চাকরি
হারিয়েছিল। উন্নত ও বেশকিছু উন্নয়নশীল অর্থনীতি ও আর্থিক খাত হোঁচট খেয়েছিল। বেকারত্ব সমস্যা বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস
করেছিল এবং পূর্ববতী সব মন্দাকে হার মানিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংকুচিত হয়েছিল। এরপর অবশ্য ২০১০-পরবর্তী সময় বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। অবশ্যই করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দা পরিস্থিতিকে পরিমাপ করার জন্য যথাযথ
সময় আসেনি বা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা সুস্পষ্ট নয়। তবে বিশ্বমানবতাকে যে একটি বড়
ধরনের অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তার যথেষ্ট আভাস রয়েছে।
করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোক্তা ও কর্মজীবী মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে অন্তত শারীরিকভাবে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান হারে কর্মজীবী মানুষ চাকরি বা জীবিকা হারাচ্ছে। কর্মসংস্থানমুখী শিল্প, যেমন পর্যটনসহ
বেশকিছু শ্রমঘন শিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় অংশের মানুষের আয়ের উৎস হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। উন্নত বিশ্ব হয়তোবা এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিনাশ্রমে নাগরিকদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতে পারবে। তবে পরিস্থিতি দীর্ঘতর হলে কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্যও তা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ব্যাংক খাতঃ
আর অর্থনৈতিক ও বিশ্ববাণিজ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত।
বিশ্ব অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারগুলোর দরপতন ও ধস এরই মধ্যে মিডিয়া জগতের একটি বড় খবর।
ব্যাংকিং খাত এরই মধ্যে অন্যান্য শিল্পের ন্যায় কর্মক্ষেত্রে বাধার মুখোমুখি হয়েছে। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে মারাত্মকভাবে।
পর্যায়ক্রমে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে এবং বিনিয়োগকৃত বা ঋণের অর্থ সময়মতো ফেরত পাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশ্ববাণিজ্য সংকোচন ও বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসংক্রান্ত অর্থায়ন পরিস্থিতিও
ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আর্থিক মন্দা মোকাবেলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত অর্থসংস্থানের জন্য কাজ করতে শুরু করেছে। এর পূর্ববর্তী মন্দার সময়গুলোয়ও কম
সুদে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে অথনৈতিক কর্মকাণ্ডকে চাঙ্গা রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যাংক এরই মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ‘ডিসকাউন্ট উইন্ডো’ ব্যবহার করে ঋণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কম সুদে ঋণ সরবরাহ করছে বিশেষত ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ঋণ সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সুদের হার কম করেছে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা ও কার্যক্রম বেছে নিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং বা ডিজিটাল লেনদেন এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তবে সাধারণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকোচনের কারণে যেকোনো ধরনের আর্থিক সেবার (মোবাইল ও অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিংসহ) ওপর প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে মন্দ ঋণের প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে, যেহেতু ঋণগ্রহণকারীরা সময়মতো ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। বিশেষত ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। সুদের হার কম করার ফলে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ সরবরাহ করছে। অন্যদিকে অনিশ্চয়তার কারণে একটি
বড় অংশের আমানত ব্যাংকগুলো থেকে উত্তোলন করছেন সাধারণ আমানতকারীরা।
বাংলাদেশ একটি ব্যাংকভিত্তিক
অর্থনৈতিক খাত। ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্ত হলে অর্থনীতির জন্য করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে উঠে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন হবে।
উন্নত দেশগুলোর মতো নয়, বরং
বাংলাদেশের বেসরকারি পর্যায়ের বিনিয়োগ সম্পূর্ণরূপে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল।
সরকারি খাতও ব্যাংকিং খাতকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ঋণের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। সারা পৃথিবীতে শেয়ারবাজারের ধস
আর্থিক খাত বিপর্যয়ের প্রাথমিক
সংকেত। বাংলাদেশের ছোট আকারের আর্থিক
বাজার এবং এর দরপতনের প্রভাব অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ মনে না হলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের
অর্থনৈতিক মন্দা ও বিপর্যয়ের প্রভাব
একটু দেরিতে প্রকাশিত ও প্রতিফলিত হয়। সুতরাং বিশ্ব ও বাংলাদেশের ব্যাংকিং
খাতের জন্য এ পরিস্থিতি শুধু শুরুর ধাক্কা।
করোনা পরিস্থিতির সমূহ ভয়াবহতা
ব্যাংকিং খাতকে বড় ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করাতে বাধ্য করতে পারে। শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার মাঝে প্রচেষ্টা আর প্রস্তুতি আশার বাণী শোনাচ্ছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ করোনা মোকাবেলায় কার্যক্রম
শুরু করেছে। নতুন একটি সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বিদ্যমান ঋণ শ্রেণীবিন্যাসকে অনুসরণ করা থেকে
বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে।
এ নির্দেশনার সুফল দেশের ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি এবং ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান দুই পক্ষই পাবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ঋণগ্রহণকারীরা ঋণ পরিশোধের সময় পাচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিসংক্রান্ত দায় এবং সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত জমার দায়
থেকে এ সময়ের জন্য পরিত্রাণ পাবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমদানি ও রফতানিকারকদের জন্য বেশকিছু নিয়মের শিথিলতা ও সুবিধা প্রদান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেমন রফতানির অর্থ পাওয়া; আমদানি বিল ও এন্ট্রি জমা করা; ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং রফতানি উন্নয়নসংক্রান্ত ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, যা ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বলবৎ থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ দেখতে পাব।
ঋণঝুঁকি মোকাবেলাসংক্রান্ত পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বেশ নাজুক সময় অতিবাহিত করছে। এ খাত সংশোধন ও পরিবর্ধন প্রচেষ্টার মাঝেই করোনা পরিস্থিতি নীতিনির্ধারকদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাত থেকে করোনা প্রতিরোধে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য করছে। এ কথা বলা যায় যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকেও করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টতা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়, যেখানে দেশের আর্থিক খাত বলতে মূলত ব্যাংকিং খাতকে বোঝানো হয়। এ পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল এ খাতটিকে আগলে রেখে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, এমনটাই কাম্য।
আজকের বিশ্ব মহামারী ১৭৯৮ সালের ম্যালথাসের বিখ্যাত জনসংখ্যা তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। থমাস ম্যালথাস সেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পন্থার কথা উল্লেখ করেন, যার কারণ হিসেবে খাদ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধানের কথা বলা হয়েছিল। হয়তো তার তত্ত্ব এ পরিস্থিতির সঙ্গে হুবহু সংগতিপূর্ণ নয়, অর্থাৎ খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান নেই। তবে স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান প্রবল। এছাড়া মানবজাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সম্পদের ব্যবধান স্পষ্ট, যা মানবজাতিকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণে উৎসাহিত করেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতি এরই মধ্যে সমূহ বিপর্যয়ের ভবিষ্যৎ লিখতে শুরু করেছে (Malthusian Catastrophe)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সম্পদের মোহ ও লোভ সংবরণের এক কঠিন শিক্ষা দিতে চলেছে আজকের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলার অনেক সফলতার কাহিনী রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানবসভ্যতা সেখানে আরেকটি পালক যুক্ত করবে—এটাই কাম্য।
Thank You
Thank You
Thank You
Thank You
Thank You
Thank You
Very Helpful