স্বপ্নের পদ্মাসেতু ও অর্থনৈতিক উত্তরণ
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই সেতুর নির্মাণকাজের মূল অংশের ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে (জুন-২০২০)-১ নদীশাসনের কাজও শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। সব মিলিয়ে অগ্রগতির পরিমাণ ৮৬ শতাংশ। কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে পদ্মাসেতুর কাজ।পদ্মাসেতু নির্মাণ হচ্ছে ৪১টি পিলারের ওপর, যার মধ্যে ২৭ নম্বর পিলারটি ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। সেতুটি তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড এর আওতাধীন চায়না মেজর ব্রীজ নামক একটি কোম্পানী। কাজ শুরু হয় ৭ ডিসেম্বর ২০১৪। এতে ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা৷(২)
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে,প্রকল্পটির ফলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কিঃমিঃ (১৭,০০০ বর্গ মাইল) বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে।এতে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে।
আরেক সমীক্ষায় এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) নির্মানের ফলে দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে লক্ষনীয় অগ্রগতি হবে।এই সেতু চালু হলে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, যানবাহন রক্ষনাবেক্ষন, জ্বালানী ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে।
এডিবি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বানিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগনের জন্য অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এছাড়াও স্থানীয় জনগন উন্নততর স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবেন।
সেতু নির্মানের ফলে নদীর তীর সংরক্ষনের ফলে নদীভাঙ্গন ও ভূমিক্ষয় কমবে। আর সেতুর নির্মান চলাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মসংস্থান হবে।এডিবি’র মতে, এই সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
.
ভারতের ‘ইকোনমিক টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এই সেতুটি (পদ্মা সেতু) বাংলাদেশের জন্য গৌরবের এবং অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারি ঘটনা। যা ২০২১ সালের মধ্যে দেশটিকে ‘মধ্যম আয়ের’ দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স (এএসএমই)-এর মতে, ঢাকা- কলকাতা (ভারত) সংযোগ সড়কে অবস্থিত এই সেতুটি এশিয়ান হাইওয়ে এবং ইউরো-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক সিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে। - (বাসস)
এছাড়া পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবনীয়,কিছু তুলো ধরা হলোঃ
১। প্রতিবছর ১.৯% হারে দারিদ্র্য হ্রাস পাবে ( বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহের প্রাক্কলন )
২। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ১.২% ( ড. জামিলুর রেজা , পদ্মা সেতুর পরামর্শক উপদেষ্টা ।)
৩। নির্মিত হওয়ার ৩১বছরের মধ্যে জিডিপি ৬০০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং২০৩২ সালের পর বাৎসরিক রিটার্ন ৩০০মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে ।
৪। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার সাথে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ শক্তিশালী হবে বা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে । ফলে ঐ অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ ,শিল্পায়ন , নগরায়ন , জীবনমান বৃদ্ধি পাবে যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে ।
৫।প্রায় ২ কোটির অধিক বেকারের কর্মসংস্থান ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে ।
৬।পদ্মা সেতু ও উভয় পাড়ের পর্যটন থেকেই প্রতিবছর কয়েক শ কোটি টাকা আয় হবে। উভয় পাড়ে সিঙ্গাপুর , হংকের আদলে আধুনিক সিটি তৈরি করা হবে ।
৭। ১৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ৯ হাজার হেক্টর জমি নদী ভাঙ্গন থেকে রেহাই পাবে । পাশাপাশি বন্যার কবল থেকেও থেকেও রক্ষা পাবে কয়েক লক্ষ মানুষ।
৮। ৫০ % ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখা ফেরি সার্ভিস চালু রাখা বন্ধ হবে এবং আদায়কৃত টোল সম্পূর্ণরুপে সরকার পাবে । ফলে প্রতিবছর সরকারের আয় বাড়বে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ডলার।
৯। সেতুর উভয় পাশেই ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ও নগরায়ন ঘটবে যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে ।
এই সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন পাল্টে যাবে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে।
এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে—সেসব এখনই বিবেচনা করা উচিত। প্রয়োজনে এখানে প্রশাসনিক রাজধানী হতে পারে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।
রেফারেন্সঃ
১. ০৫ জুন,প্রথম আলো
২.জাতীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষা,২০১৯
Post a Comment
Use Comment Box ! Write your thinking about this post and share with audience.