সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা
বাংলাদেশে বর্তমান গড় আয়ুষ্কাল ৭৩ বছর। এক প্রাক্কলনে দেখানো হয়েছে যে ২০৫০ সালে সেটা হবে ৮০ বছর। ২০৭৫ সালে হবে ৮৫ বছর। তাই স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় যে আগামী পাঁচ দশকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরেও বাংলাদেশের মানুষের ২০ থেকে ২৫ বছর আয়ু থাকবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর তখন আয় থাকবে না কিন্তু বেঁচে থাকবে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কারো না কারো দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের বয়স্কদের টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় মৃত্যুকালীন সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। বর্তমানে দেশে শুধু সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। আর সেই লক্ষ্যে ‘সবজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেন মন্ত্রিসভা। একে চুড়ান্ত রূপ দিতে ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল ২০২৩’ কণ্ঠভোটে পাস হয়।
যে কারণে এবং যাদের জন্য এই পেনশন ব্যবস্থা: বার্ধক্যজনিত কারণে একটা জনগোষ্ঠী অভাবগ্রস্থ হবে এবং একটা সময়ে তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য লাভের অধিকার দেশের প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে দেশে শুধু সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার প্রয়োজন ছিল। কারণ দেশের একটা অংশ বঞ্চিত হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। তাছাড়া বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনগণের মাঝে সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করা, জীবনযাত্রার মানকে দরিদ্রসীমার উপরের রাখা এই পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্য। এ পেনশন ব্যবস্থা এ বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুগঠিত সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় এনে তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং এ পেনশনের টাকা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা হবে এতে সরকারের ঋণ নির্ভরতা কমবে পাশাপাশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বও পাবে সর্বাধিক।
দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সকল নাগরিক এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসতে পারবে। বিশেষ ব্যবস্থায় এর বেশি বয়সীরাও এ পেনশনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী কর্মীরাও এ ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবে। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের আপাতত নতুন জাতীয় পেনশন-ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁদেরও বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের উপর ভিত্তি করে দেশের সকল নাগরিক এই পেনশন হিসার খুলতে পারবে। আর এ ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে ঐচ্ছিক থাকবে পরবর্তীতে বাধ্যতামূলক করা হবে।
এ পেনশন ব্যবস্থায় যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে: জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী একজন ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মক্ষম ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার সাপেক্ষে মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন হিসাব থাকবে। ফলে চাকরি বা পেশা পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীদের ক্ষেত্রে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকবে ।
সুবিধাভোগীরা বছরে ন্যূনতম বার্ষিক জমা নিশ্চিত করবে। অন্যথায় তার হিসাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যাবে এবং পরবর্তী সময়ে ফিসহ বকেয়া চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে সচল করতে হবে। সুবিধাভোগীরা আর্থিক সক্ষমতার ভিত্তিতে চাঁদা হিসাবে বাড়তি অর্থ জমা করতে পারবে।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা পূর্ণ হলে পেনশন তহবিলে পুঞ্জিভূত লভ্যাংশসহ জমার বিপরীতে নির্ধারিত হারে পেনশন দেওয়া হবে। পেনশনধারীরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি মাসে এই পেনশন সুবিধা ভোগ করবে। নির্ধারিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে জমাকারীর নমিনি বাকি সময়কালের জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো পেনশনভোগী ব্যক্তি যদি ৬৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে তাঁর নমিনি আরও ১০ বছর পেনশন সুবিধা পাবে। তবে জীবিত থাকলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সুবিধা পাবে। অর্থাৎ পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে ৬০ বছর হওয়ার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
পেনশন কর্মসূচিতে জমা করা অর্থ কোনো পর্যায়ে কোনোভাবে এককালীন উত্তোলণের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের প্রেক্ষিতে জমা অর্থের অর্ধেক ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।
কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদা দানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে ।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। পেনশন বাবদ মাসিক যে অর্থ পাওয়া যাবে তা পুরোপুরি আয়কর মুক্ত থাকবে।
নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন কর্মসূচিতে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে ।
পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিলে জমা করা টাকা নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে এবং পেনশন কতৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে।
এই পেনশন ব্যবস্থার আনুমানিক হিসাব: যে কোনো ব্যক্তি ১৮ বছর বয়স থেকে চাঁদা দেওয়া শুরু করে এবং তা যদি ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং মাসিক চাঁদা যদি ১০০০ টাকা হয় এবং মুনাফা ১০ শতাংশ এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ ধরা হলে ওই ব্যক্তি অবসরের পর ৮০ বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা করে পেনশন পাবে। আর ৩০ বছর থেকে শুরু হলে তার অবসরের পর পেনশনের পরিমাণ হবে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা। তবে চাঁদা পরিমাণ ১০০০ টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনও বেশি হবে।
দেশের সকল বয়স্ক নাগরিককে ৬০ বছরের পর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জনগণের মাঝে সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে উক্ত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে এক মাইলফলক। এতে করে সরকারের যেমন ঋণ নির্ভরতা কমবে তেমনি সাধারণ বয়স্ক জনগোষ্ঠী পাবে আর্থিক নিরাপত্তা ।
Prepared By: এম.আর.জেড. তুহিন